যৌনশিক্ষা এবং এর প্রয়োজনীয়তা

যৌনশিক্ষা

আমাদের দেশ, সমাজ ও সংস্কৃতিতে যৌনশিক্ষা শব্দটি এক বিশেষধরণের নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যৌনশিক্ষা বলতে আমাদের মস্তিষ্কে যা নাড়া দেয় তা মেয়েদের পিরিয়ড কিংবা ছেলেদের স্বপ্নদোষের মতো স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। বস্তুত যৌনশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও গভীরতা বিস্তর। কাউকে যৌনতা সম্পর্কে তথ্য প্রদান করা হলো যৌন শিক্ষা ব্যবস্থা। এর অর্থ এমন নয় কাউকে যৌনকর্ম শেখানো বা সেদিকে ধাপিত করা।

যৌন নিরাপত্তা, সম্মতি, প্রজনন স্বাস্থ্য, নিরাপদ যৌনতা, জন্ম নিয়ন্ত্রণ এবং যৌন সচেতনতা সহ মানব যৌনতার সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলি যৌনশিক্ষা দ্বারা নির্দেশিত হয়।

যৌনশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা

ঐতিহ্যগতভাবে আমাদের দেশে যৌনশিক্ষার কোন প্রচলন নেই, একজন বাবা-মায়ের পক্ষে তার সন্তানকে যৌন নির্দেশনা দেওয়া কিংবা এ বিষয়ে কথা বলা অনেকটাই অস্বাভাবিক প্রক্রিয়া। বয়ঃসন্ধিকালীন বাচ্চারা সমবয়সী বন্ধুমহল এবং ইন্টারনেট প্রাপ্ত নীলছবির মাধ্যমে যৌনশিক্ষা গ্রহণ করে থাকে। যা অধিকাংশ ভূলেভরা, সন্দেহজনক এবং ক্ষতিকর হবার সম্ভাবনা থাকে। কৈশরের মনে বেশি পরিমানে যৌন অনুভূতি কাজ করে, তাই এই বয়সে তাদের জন্য প্রয়োজন সঠিক গাইডলাইন, সঠিক তথ্য এবং সঠিক জ্ঞানের।

একজন শিক্ষক, পিতামাতা কিংবা অভিভাবক হিসাবে উচিৎ কৈশরের যৌনশিক্ষার দায়িত্ব নিজে বহন করা। পিতামাতা, শিক্ষক এবং সংশ্লিষ্ট প্রাপ্তবয়স্করা চান তাদের সন্তানরা সুস্থ, সুখী এবং পরিপূর্ণ জীবন যাপনের বিষয়ে উপযুক্ত জ্ঞান ও সচেতনতা অর্জন করে বড় হোক। অথচ আমরা কথা বলতে সংকোচন বোধ করি কৈশরের শরীর ও মন নিয়ে। যৌনতা শিক্ষার লক্ষ্য দ্বিগুণ। অবাঞ্ছিত গর্ভধারণ, যৌন সংক্রামিত সংক্রমণ এবং শিশু যৌন নির্যাতনের মতো যৌন আচরণের সম্ভাব্য নেতিবাচক পরিণতিগুলি হ্রাস করার পাশাপাশি, এটি যুবক-যুবতীদের জীবন এবং সম্পর্কের মান উন্নত করে সুস্থতা বাড়ায়।

যৌন শিক্ষা বিতর্ক প্রতিযোগিতার মঞ্চে দাঁড়িয়ে দেওয়া কোন একক বক্তৃতা নয়। এটি শরীর সম্পর্কে সঠিক তথ্য প্রদানের একটি চলমান প্রক্রিয়া। সামাজিক মূল্যবোধ, মনোভাব, সমস্যা, অধিকার এবং দায়িত্ব সম্পর্কে কথোপকথন। এটি কৈশোরের শরীরের পরিবর্তনগুলি নেভিগেট করতে সাহায্য করার বিষয়ে এবং তারা এটি কীভাবে অনুভব করে; কিভাবে সম্মতি দিতে বা নিতে হয়; লিঙ্গ বা শরীরের প্রকারের বৈচিত্র্য; বিবাহ বা সম্পর্কে সঠিক দ্বায়িত্ববোধ জানতে, বুঝতে ও শিখতে সহায়তা প্রদান করে। উন্নত-অনুন্নত এবং পরিপার্শ্বিক দেশগুলো ইতিমধ্যে যৌনতা শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে।

UNFPA-এর মতে, “২০১০ সালের একটি পর্যালোচনাতে দেখা যায় যে ‘লিঙ্গ-ভিত্তিক’ পাঠ্যক্রম,  শিক্ষার উপাদান যা যৌন শিক্ষার উপাদানগুলির মধ্যে সমতা বৃদ্ধি করে – যে প্রোগ্রামগুলি লিঙ্গ বিবেচনা করে না তার চেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ হ্রাসে বেশি কার্যকর। গবেষণায় এটাও দেখানো হয়েছে যে, যৌন অভিযান, কনডম ব্যবহার এবং অনুশীলন গর্ভনিরোধের ক্ষেত্রে বিলম্বের ফলে লিঙ্গীয় ভূমিকা সম্পর্কে সাম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগ করে অল্পবয়সী ছেলে মেয়েদের সুফল হয়েছে। এই ব্যক্তিরা হিংসাত্মক সম্পর্কগুলির মধ্যে সম্ভবত কম জড়িত থাকে এবং এইচআইভি এবং অজ্ঞাত গর্ভধারণের একটি নিম্ন হার থাকে।

যখন যুবক/যুবতীদের ‘বয়স-উপযুক্ত’ তথ্য দেওয়া হয় যা সঠিক, ভারসাম্যপূর্ণ এবং নিরাপত্তা, তখন সেটি তাদের দায়িত্ব এবং সুরক্ষাকে সম্বোধন করে, বিচারমূলক বা ভয়-ভিত্তিক না হয়ে, তখন এটি তাদের সচেতনতা অবলম্বনের ক্ষমতা প্রদান করে। ইউনেস্কোর ছয় দেশের সমীক্ষা এর মতো অধ্যয়নগুলি নিশ্চিত করে যে তরুণদের দায়িত্বশীল, নিরাপদ ও ভাল অবস্থানে থাকতে কেবল সঠিক তথ্যের প্রয়োজন।

‘মানসিক-স্বাস্থ্য-পেশাদার’ দের পাশাপাশি শিক্ষাবিদ এবং সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে একটি ঐক্যমত রয়েছে যে কৈশরের যৌনতা সম্পর্কে কৌতূহল সাধারণ এবং স্বাভাবিক। যৌনতা শিক্ষার বিরোধিতা একটি দুর্ভাগ্যজনক বিকাশ। কম অবগত বন্ধু, মিডিয়া এবং ইন্টারনেট তরুণদের যৌনতা শিক্ষার উৎস হতে পারে না। শিশুদের যৌনতা এবং যৌনতা সম্পর্কে সঠিক, ‘বয়স-উপযুক্ত’ এবং সাংস্কৃতিকভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ তথ্য পাওয়া উচিত।

যৌনশিক্ষা ও আমাদের সংস্কৃতি

সংস্কৃতি হল অনেকটা বিশ্বাস এবং অনুশীলনের মিশ্রণ, সেগুলি সবই উপকারী নয়। একসময় বাল্যবিবাহও আমাদের ‘সংস্কৃতির’ অংশ ছিল কিন্তু মানুষ এখন সেগুলি পুনরুদ্ধারের দাবি করে না। সংস্কৃতি এবং এর কার্যক্রম সুস্থীর নয়, এটি পরিবর্তিত এবং বিকশিত। উদাহরণস্বরূপ, ত্রিশ বছর আগে, দক্ষিণ এশীয় মহিলাদের জন্য পেশাদার কোর্স এবং ডিগ্রি অর্জন করা অস্বাভাবিক ছিল; আজ এটি সাধারণত প্রত্যাশিত যে মহিলারা পেশাদার কোর্সের জন্য পুরুষের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে।

একযুগ আগের তুলনায় স্কুলের ‘সংস্কৃতি’ও উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। অনেক শিক্ষক আজ তাদের শিক্ষাদানে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেন; একটি প্রকল্পের জন্য তথ্য সংগ্রহ করতে শিক্ষার্থীদের অনলাইনে যেতে বলা এখন সাধারণ ব্যাপার। বিগত বছরগুলিতে তরুণদের প্রয়োজনীয় দক্ষতার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে স্কুলগুলিতে নতুন কোর্স চালু করা হয়েছে। তাহলে যৌনশিক্ষা নয় কেন?

ধর্ষণ ও যৌনশিক্ষা

ধর্ষণরোধে আইনের কঠোর প্রয়োগ আর নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি যৌন শিক্ষারও প্রয়োজন রয়েছে৷ মানুষের যৌনাঙ্গ, যৌনতা, সম্মতি, সম্পর্কের বিষয়ে আমাদের দেশের মানুষের প্রকৃত জ্ঞান জরুরি৷ আর এসব জানলে অনেক ভ্রান্ত ধারণা এমনিতেই ঘুঁচে যাবে, কমবে নারী-পুরুষের মধ্যকার মানসিক দূরত্ব৷ 

জার্মানির কথাই আগে বলি৷ ২০১৫ সালে সিরিয়ার শরণার্থীদের জন্য দুয়ার খুলে দেয় ইউরোপের দেশটি৷ তখন শুধু সিরিয়া নয়, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়ার নানা দেশ থেকে প্রায় দশ লাখ শরণার্থী জার্মানিতে প্রবেশ করে৷ এই বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠী আসার পর জার্মানিতে ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার নানা খবর শোনা গেছে৷ আর সেসব ধর্ষণের পেছনে কখনো কখনো অভিবাসীদের জড়িত থাকার বিষয়টিও গণমাধ্যমে আসতে থাকে৷ অভিবাসীদের সম্পর্কে অনেক জার্মানের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির একটি কারণও এসব ধর্ষণের অভিযোগ৷

জার্মানি তখন ধর্ষণের ঘটনা রোধে আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি আরেকটি উদ্যোগ নিয়েছিল৷ অভিবাসীদের যৌন শিক্ষা দিতে একটি বিশেষ ওয়েবসাইট চালু করা হয়েছিল জার্মান সরকারের অর্থায়নে৷ যৌন শিক্ষা বিষয়ক ওয়েবসাইটটিতে নারী-পুরুষের শরীর, যৌনতা, পরিবার, গর্ভধারণ বিষয়ক নানা তথ্য দেয়ার পাশাপাশি পরষ্পরের মধ্যে সম্পর্ক, সম্মতি, আইনি অধিকারের বিষয়াদিও তুলে ধরা হয়েছিল। যৌন শিক্ষা জার্মানির স্কুলে অনেক আগে থেকেই দেয়া হয়৷ এই ওয়েবসাইট সেখানে যুক্ত হয়েছে অভিবাসীদের জন্য যাতে তারাও বিষয়টি সম্পর্কে সম্যক ধারণা পায়৷ অথচ, আমাদের দেশের পরিস্থিতি এখনো অনেকটাই ভিন্ন৷ অভিবাসী দূরে থাক, দেশটির সাধারণ মানুষেরই যৌন শিক্ষা পাওয়ার কোনো সুনির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্ম নেই৷ একটি পর্যালোচনায় জানা গেছে অধিকাংশ শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটে ভিক্টিমের নিকটতম লোকের দ্বারা। যদি এদেশে শিশুদেরকে যৌন সচেতনতার সম্ভব্য উপায়গুলো সম্পর্কে (ভাল স্পর্শ, খারাপ স্পর্শ) ধারনা দেওয়া হতো তাহলে তারা পূর্ব সতর্কতা অবলম্বন করতে পারতো।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিগত তিন বছরে সারাদেশে ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন মোট ৪,৩৬১ জন। একবার ভেবে দেখুন তো যেদেশে যৌনশিক্ষা গ্রহণের একমাত্র মাধ্যম সমবয়সী বন্ধু ও পর্ণগ্রাফি সেদেশে ধর্ষনচিত্র বাড়বেনা কেন?

যৌন শিক্ষার মাধ্যম

যৌন শিক্ষা অনানুষ্ঠানিকভাবে শেখানো যেতে পারে। যেমন কেউ পিতা-মাতা, বন্ধু, ধর্মীয় নেতা বা মিডিয়ার মাধ্যমে কথোপকথন থেকে তথ্য পেতে পারে। এটি পত্রিকার পরামর্শ কলাম বা যৌন শিক্ষা ওয়েব সাইটগুলির মাধ্যমে বিতরণ করা যেতে পারে। প্রশিক্ষণের বিষয়টি মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমেও দেয়া যেতে পারে। যেমন টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইত্যাদি। কৈশোরকালীন শিশুরা এসব বিষয় নিয়ে তাদের পিতা মাতা বা পারিবারিক সদস্যের সাথে কথা বলতে অস্বস্তিবোধ করে থাকে। একটি গবেষনায় দেখা গেছে গনমাধ্যমের সাহায্যে প্রচারণা চালালে তা বেশি কার্যকর এবং অনিরাপদ মিলনের ঝুঁকি কমায়। যেমন টেলিভিশনে বিজ্ঞানপের মাধ্যমে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচার।

পাবলিক স্কুলগুলিতে বেশির ভাগ লোকই যৌন শিক্ষার পক্ষে মতানৈক্য করে থাকে। এবং এটি একেবারে বিতর্কিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ অধিকাংশ বিষয়ের মতই যৌন শিক্ষা মানবজাতির বিশেষভাবে সংবেদনশীল এবং অত্যন্ত ব্যক্তিগত অংশের সাথে সংশ্লিষ্ট।

রিশো ও যৌন শিক্ষা

রিশো তিন শ্রেণীতে যৌনশিক্ষা প্রদান করে থাকে। আপনি আজই যোগ দিতে পারেন আমাদের ফ্রি কোর্সগুলোতে। যৌনতা শিক্ষা গ্রহন করুন

  • একজন পিতামাতা বা অভিভাবক হিসাবে
  • একজন কৈশোর বা যুবক হিসাবে
  • একজন শিক্ষক বা মনোবিজ্ঞানী হিসাবে।
Scroll to Top