ভ্যাসেকটমি: জন্ম নিয়ন্ত্রণে পুরুষ বন্ধ্যাকরণ

জন্ম বিরতীকরনে কেবলমাত্র নারীরই ভূমিকা রয়েছে বিষয়টা এমন নয়। চাইলে পুরুষরাও স্থায়ীভাবে জন্ম নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। পদ্ধতিটির নাম ভ্যাসেকটমি প্রক্রিয়া।

গর্ভপাতের বিকল্প ভ্যাসেকটমি করার পরামর্শ দিচ্ছেন আন্দোলনরত কিছু আইরিশ।

ভ্যাসেকটমি কি?

ভ্যাসেকটমি পদ্ধতি হল পুরুষদের জন্য স্থায়ী জন্মবিরতিকরণ পদ্ধতি। একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দ্বারা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শুক্রাণু বহনকারী অন্ডকোষের ছোট টিউবগুলো কেটে বা বন্ধ করে দেওয়ার মাধ্যমে ভ্যাসেকটমি করা হয়। ভ্যাসেকটমির সময় পুরুষের ভাস ডিফারেন্স কেটে বেধে দেবার ফলে সহবাসের সময় শুক্রাণু  মূত্রনালিতে প্রবেশ করতে পারেনা। এই কারনে পুরুষের শুক্রাণু নারীর ডিম্বানুকে কোন উপায়ে নিষিক্ত করতে পারেনা, তাই ভ্যাসেকটমির কার্যক্ষমতা ১০০% পর্যন্ত ধরা হয়।

ভেসেকটমি কিভাবে কাজ করে?

মাইক্রোস্কোপিক কোষ শুক্রাণু; যা আপনার অন্ডকোষে তৈরি হয়। সহবাসের সময় এটি নারীর ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করার মাধ্যমে গর্ভধারণ ঘটায়। শুক্রাণু ভাস ডিফারেন্স নামীয় দুইটি টিউবের মধ্য দিয়ে অন্ডকোষ থেকে বের হয়ে যায় এবং অন্যান্য তরলের সঙ্গে মিশে বীর্য গঠন করে। এই বীর্যে থাকা শুক্রাণু একজন নারীকে গর্ভিণী করে তোলে।

প্রতিটি ভ্যাসেকটমিতে ভাস ডিফারেন্স টিউব কেটে বা সিল করার মাধ্যমে ব্লক করে দেওয়া হয়। যার কারণে অন্ডকোষে তৈরী হওয়া শুক্রাণু অন্ডকোষ থেকে বের হতে পারেনা এবং বীর্যে মিশে পুরুষাঙ্গ পর্যন্ত আসতে পারেনা। এখানে আপনার অন্ডকোষে তৈরী হওয়া শুক্রাণু আপনার শরীর দ্বারা নিজে নিজেই শোষিত হয়।  ভ্যাসেকটমি করার তিন মাস পরে আপনার বীর্যে কোন প্রকার শুক্রাণু থাকবে না। তাই তখন আপনার বীর্য কোন নারীকে গর্ভবতীও বানাতে পারবে না।

ভ্যাসেকটমির পূর্ব সিদ্ধান্ত

যদি আপনি নিশ্চিত হন যে আপনি আর কোন সন্তান চান না বা একেবারেই সন্তান নিতে চান না, তবেই আপনি ভ্যাসেকটমি করতে পারেন।

ভ্যাসেকটমি গ্রহণের পূর্বে স্ত্রীর সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করুন; জন্ম বিরতীকরনের জন্য ভ্যাসেকটমিই আপনাদের সর্বোচ্চ নিরাপদ পদ্ধতি কিনা। কেননা জন্ম বিরতীকরনের জন্য আরো অনেক পদ্ধতি রয়েছে। 

যদি আপনি ত্রিশ বছরের নিচে হন একইসাথে নি:সন্তান থাকেন। তবে ভ্যাসেকটমি আপনার জন্য না। 

মনে রাখবেন একবার আপনি ভ্যাসেকটমি করলে এটি বিপরীতকরন করা কঠিক বিষয়। বিপরীতকরন করালেও সেটি আপনার সন্তান দানের সম্ভাবনা খুবই কম। যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস এর এক গবেষণায় দেখা দেছে যারা ভ্যাসেকটমির দশ বছরের মধ্যে বিপরীতকরনের চেষ্টা করেন তাদের সাফল্যের হার ৫৫ শতাংশ।আর যাদের ১০ বছরের পরে বিপরীতকরণ করা হয় তাদের সাফল্য মাত্র ২৫ শতাংশ।

একজন সার্জন আপনার ভাস ডিফারেন্স জোড়া লাগাতে পারলেও সেখানে আপনার দ্বারা গর্ভাবস্থা সম্ভব নাও হতে পারে। তাই জেনে বুঝে এবং দৃঢ় সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার পরেই ভ্যাসেকটমির চিন্তা মাথায় আনুন।

ভ্যাসেকটমির ধরন

সব ধরনের ভ্যাসেকটমির পদ্ধতি ও উদ্দেশ্য একই, কেবলমাত্র ভ্যাসেকটমি করার জন্য ব্যবহৃত কৌশলগুলির মধ্যে সামান্য ভিন্নতা রয়েছে। এই ভিন্নতার দৃষ্টিকোন থেকে ভ্যাসেকটমির দুটি ধরন হয়েছে।

  • প্রচলিত ভ্যাসেকটমি
  • নো-স্ক্যাল্পেল ভ্যাসেকটমি
VASECTOMY PHOTO

প্রচলিত ভ্যাসেকটমি

প্রচলিত ভ্যাসেকটমির জন্য প্রথমে একজন অভিজ্ঞ অ্যানেস্থেটিক ডাক্তার আপনার অণ্ডকোষ অসাড় (অবস) করবে। এরপর তারা আপনার শুক্রাণু বহনকারী টিউব পর্যন্ত পৌছানোর জন্য অন্ডকোষের দুইপাশে একটি বা দুইটি স্থানে ছোট করে কাটবে।

একজন সার্জন ডাক্তার আপনার ভাস ডিফারেন্স টিউবগুলো কেটে মাঝখান থেকে কিছু অংশ অপসারণ করবে। এবং টিউবের মাথাগুলো বেধে দিবে অথবা সিল করে দিবে। এরপর অন্ডকোষের কাটাস্থান গুলো সেলাই করে দিয়ে আপনার প্রচলিত ভ্যাসেকটমি সম্পূর্ণ করবে।

নো-স্ক্যাল্পেল ভ্যাসেকটমি

নো- স্ক্যাল্পেল ভ্যাসেকটমি হলো পুরুষদের জন্য কাটা ছেড়া বিহীন ভ্যাসেকটমি প্রক্রিয়া। এই পদ্ধতিতে ভ্যাসেকটমি করার জন্য ছুড়ি বা ব্লেড লাগেনা ; যার জন্য এটিকে নো- স্ক্যাল্পেল ভ্যাসেকটমি (এনএসভি)) বলা হয়। এনএসভি যেহেতু কাটা ছেড়ার প্রয়োজন হয়না তাই সেলাইয়েরও দরকার পরেনা। তবে প্রচলিত ভ্যাসেকটমির মতই একজন অভিজ্ঞ অ্যানেস্থেটিক ডাক্তার দ্বারা অণ্ডকোষ অসাড় (অবস) করা হয়। এরপর অন্ডকোষের ত্বকের নীচে একটি ছোট গর্ত বা ছিদ্র করে প্রচলিত ভ্যাসেকটমির মতই শুক্রাণু বহনকারী টিউবগুলো বেধে বা সিল করার মাধ্যমে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এবং পূর্বের মতই টিউবের কিছু অংশ অপসারণ করতে হয়। এরপর বেধে দেওয়া বা সিল করা টিউবগুলি ছিদ্র বরাবর ভিতরে প্রতিস্থাপন করতে হয়। এভাবে নো-স্ক্যাল্পেল পদ্ধতিতে ভ্যাসেকটমি সম্পন্ন করা হয়।

কোন ভ্যাসেকটমি কৌশল অধিকতর ভালো?

অধিকাংশ চিকিৎসা গবেষণায় ধারাবাহিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে নো-স্ক্যাল্পেল ভ্যাসেকটমির সাথে তুলনা করলে প্রচলিত ভ্যাসেকটমিতে রক্তপাত ও সংক্রমণের জটিলতা বেশি থাকে। 

Incisional vasectomy VS no scalpel vasectomy

ভ্যাসেকটমির জন্য কতদিন হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হয়?

ভ্যাসেকটমি হলো খুবই সাধারণ এবং ছোট্ট একটি অপারেশন। একজন অভিজ্ঞ ডাক্তারের এটি সম্পূর্ণ করতে বড়জোড় ৩০ মিনিট সময় লাগে। অপারেশনের পর আপনাকে ঘন্টাখানেক বিশ্রামের জন্য হাসপাতালে রাখতে পারে। এরপরই আপনাকে বাড়ি ফেরার জন্য রিলিজ করে দিবে। যেহেতু ভ্যাসেকটমি অতি সাধারণ প্রক্রিয়া তাই এর জন্য আপনাকে হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হবে না।

ভ্যাসেকটমি কতটা কার্যকরী?

বলা চলে ভ্যাসেকটমি ১০০% কার্যকরী। কেননা এটি সরাসরি আপনার বীর্যে শুক্রাণুর উপস্থিতি বন্ধ করে। তবে ভ্যাসেকটমি করার তিন মাস পর্যন্ত সন্তান ধারনের উদ্দেশ্যে খোলামেলা সহবাস অনিরাপদ।

ভ্যাসেকটমি করার তিন মাস পর একজন ল্যাব বিশেষজ্ঞ আপনার বীর্য পরিক্ষা করবেন। আপনার বীর্যে শুক্রাণুর উপস্থিতি না থাকলে আপনাকে খোলামেলা যৌনমিলনের পরামর্শ দিবেন।

ভ্যাসেকটমি পরবর্তী 

ভ্যাসেকটমির পর আপনার অন্ডকোষ হালকা অস্বস্তি ,ফোলা ফোলা ভাব, ব্যাথা থাকতে পারে। এবং ভ্যাসেকটমির পর প্রথম কয়েকটি বীর্যপাতের সময় আপনার বীর্যে রক্ত ​​পড়া সাধারণ ব্যাপার। এটা ক্ষতিকর নয়।

ভ্যাসেকটমি পরবর্তী অন্তত সাত দিন যৌনসঙ্গম এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেন ডাক্তারেরা। এবং কমপক্ষে ৮ থেকে ১২ সাপ্তাহ গর্ভনিরোধের জন্য অন্য আরেকটি পদ্ধতি ব্যবহার করতে বলেন। কেননা আপনার টিউবে লেগে থাকা শুক্রাণু শোষিত হতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়।

ভ্যাসেকটমির সুবিধা এবং অসুবিধা 

সুবিধাঃ

  • ভ্যাসেকটমি গর্ভাবস্থা প্রতিরোধে ৯৯ শতাংশেরও বেশী কার্যকরী।
  • এটি আপনার স্বাস্থ্যের উপর দীর্ঘ প্রভাব ফেলে না।
  • আপনার হরমোনের মাত্রা, যৌন পার্ফমেন্সের উপর কোন প্রভাব ফেলে না।
  • বন্ধাত্বকরনের সহজ এবং বিকল্প পদ্ধতি হিসাবে বেছে নেওয়া যেতে পারে।

অসুবিধাঃ

  • একটি ভ্যাসেকটমি সহজে বিপরীত মুখী করা যায় না।
  • অপারেশনের পরে আপনার গর্ভনিরোধক ব্যবহার চালিয়ে যেতে হবে যতক্ষণ না পরীক্ষায় দেখা যায় আপনার বীর্য শুক্রাণুমুক্ত।
  • সম্ভাব্য জটিলতার মধ্যে রয়েছে অণ্ডকোষের অভ্যন্তরে রক্তের সংগ্রহ (হেমাটোমা), শক্ত পিণ্ড(টিউব থেকে শুক্রাণু বের হওয়ার কারণে), সংক্রমণ, বা দীর্ঘমেয়াদী অণ্ডকোষে ব্যথা।
  • কেটে দেওয়া ভাস ডিফারেন্স টিউব নিজে থেকে জোড়াই লাগতে পারে, তবে এটি বিরল।

মনে রাখবেন, ভ্যাসেকটমি আপনাকে এইডসের মত যৌন সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারেনা।তাই ক্ষেত্রবিশেষ আপনাকে কন্ডম ব্যবহারের প্রয়োজন হতে পারে।

বাংলাদেশে কোথায় ভ্যাসেকটমি করা হয়?

সরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক, সরকার অনুমোদিত এনজিও এবং বেসরকারি ক্লিনিকে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দ্বারা ভ্যাসেকটমি করা হয়।

বাংলাদেশের যে সকল হাসপাতালে ভ্যাসেকটমি করা হয়ঃ

  • উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স 
  • মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র 
  • মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও ক্লিনিক
  • সরকার অনুমোদিত এনজিও ও বেসরকারী হাসপাতাল / ক্লিনিক
  • কখনো বিশেষ ক্যাম্প সংগঠনের মাধ্যমে কম অগ্রগতি সম্পন্ন এলাকায় বিভিন্ন ক্যাম্পের মাধ্যমে ভ্যাসেকটমি করা হয়।

লক্ষ্য করুন, আমরা আপনাকে ভ্যাসেকটমি করার জন্য উষ্কানি কিংবা চাপ প্রয়োগ করছি না; সহবাস কেবলমাত্র তথ্য সরবরাহ করে।

তথ্যের উৎস, ইউকিপিডিয়া, প্লান্ড প্যারেনহুড ফেডারেশন অব আমেরিক, ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস ,সোশ্যাল মার্কেটিং কম্পানি, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর আরও অন্যান্য।

2 thoughts on “ভ্যাসেকটমি: জন্ম নিয়ন্ত্রণে পুরুষ বন্ধ্যাকরণ”

  1. Pingback: পরিবার পরিকল্পনা এবং জন্ম নিয়ন্ত্রণের যতসব পদ্ধতি - সহবাস | Sohobas

  2. Pingback: কখন জন্মনিয়ন্ত্রণ পিলের কার্যক্ষমতা কমে যায়? - সহবাস | Sohobas

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top