গর্ভবতী মহিলা সম্পর্কে শিশুর মনে কৌতুহলি কিছু প্রশ্ন জাগতে পারে। তাই আপনি যদি গর্ভবতী হন আপনাকে প্রস্তুত থাকতে হবে প্রশ্নত্তর গুলি মোকাবিলা করার।
একটি বাচ্চা কিভাবে তোমার পেটে মধ্যে ঢুকলো? বাচ্চাটাকে কি তুমি খেয়ে ফেলছো?
বাচ্চাটি কিভাবে এবং কখন বের হয়ে আসবে তোমার পেটের ভিতর থেকে?
নবজাতকের জন্মপ্রক্রিয়া নিয়ে শিশুর জানতে চাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এটি আপনার শিশুকে জ্ঞান অন্বেষণ ও বিকশিত করতে সাহায্য করবে, যদি না আপনি শিশুকে ভূল তথ্য বা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা না করে থাকেন।
সেদিন সোনাপট্টি স্কুলের বাড়ান্দায় লক্ষ্য করলাম ৬/৭ বছর বয়সী কিছু বাচ্চা আলোচনা করছে তাদের জন্ম প্রক্রিয়া নিয়ে।
১ম বাচ্চাঃ তোরা কি জানিস আমার মা আমাকে কিভাবে পেয়েছিল? যখন মা আমাকে পেতে চেয়েছিল নামাজ পড়ে মুনাজাতে চেয়েছিল। আর তারা আমাকে উপহার হিসাবে পেয়েছে।
২য় বাচ্চাঃ আমার মা বলেছে আমাকে তারা মার্কেট থেকে কিনে এনেছে, যদি আমি তাদের কথা না শুনি আমাকে আবার দোকানে ফেরত দিয়ে আসবে।
৩য় বাচ্চাঃ কিন্তু আমার ভাই তো বলেছে আমাকে নাকি ডাস্টবিন থেকে তুলে এনেছিল আমার বাবা। আমি নাকি তাদের আসল মেয়ে নই।
৪র্থ বাচ্চাঃ তোরা কিছু জানিস না, যখন বাবা মাকে চুমু খায় তখন শিশুরা পেটে আসে। আমার আন্টির পেটে একটা বেবি হয়েছে। কিছুদিন পর ডাক্তারেরা বেবিটাকে পেট কেটে বের করবে।
আমরা আমাদের সন্তানকে যেভাবে যৌনতা শেখাবো, তারা সেভাবেই শিখতে শুরু করবে। অনেক বাবা মা’ই ইচ্ছাপোষণ করেন যে- তাদের সন্তানকে সঠিক এবং বয়স-উপযুক্ত পারিবারিক যৌনতা শিক্ষা প্রদান করতে। তারা শুধু জানেন না- কখন এবং কীভাবে তাদের সন্তানকে যৌনতা সম্পর্কে বলবে?
আজকের লেখায় আমি কৌশলগুলো আলোচনা করতে চলছি-
কিভাবে আপনার বাচ্চার বিব্রতকর প্রশ্নের মুখোমুখি হবেন?
বাচ্চাদের কখন যৌনতা সম্পর্কে জানা উচিত?
এবং কীভাবে আপনার সন্তানদের যৌনতা শেখানো শুরু করবেন?
আলোচনাগুলি নিম্নলিখিত পয়েন্ট আকারে তুলে ধরছি:
১..যৌনতা নিষিদ্ধ নয়: যৌনশিক্ষা এবং এর প্রয়োজনীয়তা বিস্তর। শিশুকে তার ভিতরে চলতে থাকা যৌন সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর জানাতে হবে, এর আগে তাকে বুঝাতে হবে যে এটি সম্পর্কে কথা বলা বিব্রত ও আপত্তিকর। আমরা প্রাপ্তবয়স্করা যদি এই বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা এড়িয়ে চলি, তবে সম্ভাবনা রয়েছে যে তারা ইন্টারনেটে যা দেখে কিংবা সমবয়সী সঙ্গী থেকে যা সংগ্রহ করে তা দীর্ঘমেয়াদে ভুল এবং বিভ্রান্তের সমন্বয়ে তারা যৌন সম্পর্কে তাদের নিজস্ব বোঝাপড়া তৈরি করবে।
২..শিশুদের ভাষায় কথা বলুন: আপনার বাচ্চাকে যৌনকর্ম শেখাতে বলছি না। কেবলমাত্র তাকে সহজ ভাষা ও বয়স অনুযায়ী তথ্য দিন। যা আপনার শিশুর জন্য অতিরিক্ত চাপ বা অপ্রতিরোধ যোগ্য হবে না।
৩..গোপনাঙ্গের সঠিক নাম: শিশুদের প্রশ্নের উত্তর দিতে এবং তাদের সঙ্গে যৌন আলাপচারিতায় গোপনাঙ্গের সঠিক ও ইংরেজি নাম ব্যবহার করুন। উদাহরণস্বরূপ- ওভারি, পেনিস,যোনিদ্বার, ব্রেস্ট, শুক্রাণু, ডিম্বানু ইত্যাদি।
এমনসব শব্দ ব্যবহার এড়িয়ে চলুন যা দৃষ্টিকটু বা শুনতে খারাপ শোনায়। মনে রাখবেন- আপনি যে ভাষায় কথা বলবেন শিশুরা পরবর্তীতে ব্যবহারের জন্য সেটাই মনে রাখবে।
৪..জনসম্মুখে বিব্রতকর পরিস্থিতি: আপনার সন্তান অপ্রয়োজনীয় সময়ে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে আপনার জন্য একটি বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে, উদাহরণস্বরূপ- আপনার সাত বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে ঔষধ কিনার উদ্দেশ্যে ডিসপেনসারিতে গেছেন, অতঃপর আপনার ছেলে দেয়ালে ঝুলানো স্ট্রবেরী ফ্লেভারের কনডমের প্যাকেট দেখিয়ে ওটার সম্পর্কে জানতে চাইলো। এমত পরিস্থিতিতে আপনি কি করবেন?
তাকে স্ন্যাপ না করার চেষ্টা করুন। কেবলমাত্র মুহূর্তটুকু পাশ কাটিয়ে চলুন। এই বলে পরিস্থিতি সামাল দিন যে- “তুমি খুব ভালো প্রশ্ন করেছো আমরা বাড়ি ফিরে এর উত্তর দেব।” প্রশ্নত্তর দেবার জন্য আপনি যে সময় উল্লেখ করেছেন সেই সময়েই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করুন যাতে শিশুটি আপনাকে এই প্রশ্ন করে খারাপ কিছু করেছে বলে মনে না করে।
৫..যৌনতা শিক্ষা চলুক চলমান কথোপকথনে: যৌনতা শিক্ষা এককালীন জিনিস নয়; আলোচনাটি একটি নির্দিষ্ট দিনে সীমাবদ্ধ থাকার দরকার নেই। এটি একটি উন্মোচিত প্রক্রিয়া হওয়া উচিত যেখানে আমরা প্রতিদিনের সুযোগগুলি ব্যবহার করতে পারি। যখন আপনার সন্তান একটি ছাগলকে বাচ্চা প্রসব করতে দেখে কিংবা হাসপাতালে আপনার সন্তান একজন মাকে তার বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে দেখে জানার আগ্রহ প্রকাশ করে। আপনি আপনার শিশুকে যাই বলুন না কেন- আপনার ভাষা এবং বয়স-উপযুক্ত তথ্যের সমন্বয় সংযত রাখুন।
৬..ব্যক্তিগত শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ: শিশুকে ব্যক্তিগত শরীরের অঙ্গ এবং ভালো স্পর্শ ও খারাপ স্পর্শ সম্পর্কে শেখান। এছাড়াও তাদের জানতে হবে ব্যক্তিগত অঙ্গ প্রদর্শন জনসাধারণের মধ্যে করা ঠিক নয়, এটি ব্যক্তিগতভাবে করা উচিত।
আলোচনা এড়িয়ে চলার চেয়ে বয়স-উপযুক্ত উপায়ে এবং সহজবোধ্যভাবে যৌনতার বিষয়ে শিশুদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যৌন সম্পর্কে সুস্থ অনুভূতি জাগাবে। বার্তাটি এমনভাবে প্রকাশ করা উচিত যাতে এটি যৌনতাকে “লজ্জাজনক কাজ” হিসাবে বোঝায় না। এই বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত বয়স-উপযুক্ত বই রয়েছে যা আপনার জন্য সহায়ক হতে পারে।
এখানে কয়েকটি উদাহরণ টেনে বয়স-উপযুক্ত তথ্যের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছি-
১..গোপনাঙ্গ: ২/৩ বয়সী বাচ্চার সাথে কথা বলার ক্ষেত্রে গোপনাঙ্গের সঠিক নাম ব্যবহার করুন। যোনিকে পুচকি বা লিঙ্গকে টুনটুনি,’পক্কির ছা’ এধরণের শব্দ ব্যবহার করা উচিত নয়। স্তনকে স্তনই বলা উচিত। এগুলোকে কখনই মায়ের অতিরিক্ত পেট বলা উচিত নয়।
২..যৌনক্রিয়া: ৭/৯ বছর বয়সী সন্তানের সঙ্গে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করুন যে এটি প্রেমের একটি শারীরিক রূপ যা মা এবং বাবার মতো বড়রা একে অপরের সাথে ভাগ করে নেয়।
৩..জন্মদ্বার: যদি আপনার শিশু ইতিমধ্যে শরিরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সম্পর্কে জানে, তাহলে তাকে বলতে পারেন শিশুর জন্মদ্বার হলো মায়ের যোনিপথ। আর যদি ২/৫ বছরের অবুঝ বাচ্চা হয় তাকে বোঝাতে পারেন কিভাবে সিজারের মাধ্যমে একটি বাচ্চার জন্ম দেয় ডাক্তারেরা। মনে রাখবেন আপনার শিশুকে যৌনতা শিক্ষা দিতে চাইলে আপনাকে ১০০% সৎ ও আত্মবিশ্বাসী হতে হবে।
৪..নাভির নিচের চুল: আপনার সন্তানের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে নাভির নিচে চুল গজায় কেন? তাকে এভাবে বলতে পারেন- সৃষ্টিকর্তা আমাদের শরীরের কিছু অংশকে রক্ষা করার জন্য এটিকে এমনভাবে ডিজাইন করেছেন। চোখের সুরক্ষায় ভ্রু যেমন, মাথার সুরক্ষায় চুল যেমন মাথাকে রক্ষা করে, তেমনি এখানে চুল আমাদের গোপনাঙ্গকে রক্ষা করে থাকে।
৫..মাসিক/পিরিয়ড: ৫/৭ বছর বয়সী শিশুকে জানান পিরিয়ড সম্পর্কে। প্রতি মাসে, মায়ের শরীর একটি ডিম তৈরি করে এবং শরীর ডিম গ্রহণের জন্য পর্যাপ্ত রক্ত এবং টিস্যু তৈরি করে নিজেকে প্রস্তুত করে। কিন্তু ডিম যদি বাচ্চাতে পরিণত না হয়, তাহলে শরীর থেকে সমস্ত রক্ত এবং টিস্যু বেরিয়ে যায়, যার ফলে মাসিক বা পিরিয়ড হয়। উল্লেখ করুন যে এটি একটি খুব স্বাভাবিক প্রক্রিয়া এবং এতে ভয় পাওয়ার বা বিরক্ত হওয়ার কিছু নেই। প্রতিটি ছেলে শিশুর উচিত এটাকে সম্মান করা, কেননা ঘটনাটি তার মায়ের সাথেও ঘটে।
৬..ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন: ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতন হল যখন কেউ তোমার অনুমতি ছাড়া তোমার শরীরের গোপনাঙ্গ স্পর্শ করে যা তুমি পছন্দ করো না বা ব্যাথা অনুভব করো। তোমার এটি থামাতে এবং সাহায্যের জন্য চিৎকার করা উচিত, দেশে শিশু যৌন নির্যাতনের সংখ্যা ক্রমশই বেড়ে চলছে। তাই প্রতিটি মেয়ে শিশুকে জানাতে হবে ধর্ষণ ও এর প্রতিরোধী সতর্কতা সম্পর্কে।
একজন পিতা বা মাতা হিসাবে আপনাদের সকলের অবশ্যই সমান্তরাল অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং আপনারা সামান্য বিস্ময় থেকে অনুরূপ প্রশ্নের সম্মুখীন হবেন। যদি ইতিমধ্যে এই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলা করে থাকেন তাহলে কিভাবে আপনার সন্তানের সঙ্গে কথোপকথন তৈরি করেছেন তা জানাতে পারেন। হয়তোবা আপনার দেওয়া এই মন্তব্যটি অন্য আরেকটি মায়ের জন্য কাজে দেবে।