জন্ম নিয়ন্ত্রণে স্তন্যদান: ল্যাকটেশনাল অ্যামেনোরিয়া

আজকের লেখায় আমি আলোচনা করবো জন্ম নিয়ন্ত্রণের একটি প্রাকৃতিক পদ্ধতি সম্পর্কে। পদ্ধতিটির নাম ল্যাকটেশনাল অ্যামেনোরিয়া।

lactational amenorrhea | Risho

ল্যাকটেশনাল অ্যামেনোরিয়া কি?

সহজ ভাষায় বললে ল্যাকটেশন হলো বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানো; আর অ্যামেনোরিয়া বলতে বোঝায় কারো মাসিক রক্তচাপ বন্ধ থাকা। অর্থ্যাৎ কেউ যখন তার বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ান এবং একইসাথে তার মাসিক রক্তচাপ বন্ধ থাকে সেই সময়কালকে ল্যাকটেশনাল অ্যামেনোরিয়া বলা হয়।

বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ালে পিরিয়ড কেন বন্ধ থাকে?

অস্ট্রেলিয়া সরকারের একটি স্বাস্থ্যবিষয়ক ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, আপনি যদি আপনার শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ান, তাহলে প্রসবের পর কয়েক মাস আপনার পিরিয়ড ফিরে নাও আসতে পারে। এর কারণ হল প্রোল্যাক্টিন নামের একটি হরমোন; যা আপনার স্তনে দুধ তৈরি করছে।

প্রোল্যাক্টিন কি?

ব্রিটিশ সরকারের ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ’ ওয়েবসাইটের একটি প্রতিবেদন থেকে প্রোল্যাক্টিন সম্পর্কে আরেকটু বিস্তর ধারণা পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছে, প্রোল্যাক্টিন হল মস্তিষ্কের পিটুইটারি গ্রন্থি হতে তৈরি হওয়া একটি হরমোন। যা গর্ভাবস্থায় এবং জন্মদানের পরে স্তন বৃদ্ধি করে এবং স্তনে দুধ উৎপন্ন করে ।

প্রোল্যাক্টিন শুধু দুধই উৎপাদন করেনা, যখন কোন বাচ্চা দুধ পান করে তখন এটি নারীর ডিম্বানুর ডিম তৈরী বন্ধ করতে ডিম্বাশয়ে এক বিশেষ সংকেত পাঠায়। প্রোল্যাক্টিন হরমোনের এই উচ্চ স্তর বুকের দুধ তৈরির পাশাপাশি এটি সেই প্রক্রিয়ার সাথেও কাজ করে যাতে আপনার পিরিয়ড বন্ধ হয়।

ল্যাকটেশনাল অ্যামেনোরিয়া কি সবার জন্য কাজ করে?

না, শুধুমাত্র বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানো মানে এই নয় যে আপনি গর্ভাবস্থায় আশংকামুক্ত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, জন হোপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিষয়ক তহবিলের সম্মিলিতভাবে প্রকাশ করা গবেষণামূলক বইটিতে বলা হয়েছে, জন্ম নিয়ন্ত্রণের এই প্রাকৃতিক পদ্ধতিটি ব্যবহার করার জন্য আপনাকে নুন্যতম তিনটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে।

ল্যাকটেশনাল অ্যামেনোরিয়া কার্যকারিতার শর্তাবলী

  • বাচ্চার বয়সসীমা।
  • অ্যামেনোরিয়ার যথার্থতা।
  • স্তন্যদানের মাত্রা।

১. বাচ্চার বয়সসীমা

ল্যাকটেশনাল অ্যামেনোরিয়া কার্যকরীর হওয়ার প্রথম শর্ত বাচ্চার বয়স ৬ মাসের কম হতে হবে। অর্থ্যাৎ যে বাচ্চাটাকে আপনি বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন, তার বয়স যদি ৬ মাসের বেশি হয়, তাহলে আপনার জন্য এই জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ফেইল করার সম্ভাবনা রয়েছে।

এখন হয়তোবা ভাবতে পারেন, বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ালেই তো হলো। বাচ্চার বয়স ৬ মাসের নিচেই কেন হতে হবে? চলুন সংক্ষেপে বিশ্লেষণ করা যাক-

সাধারণত একটি ৬ মাসের নিচের বাচ্চার প্রধান খাদ্য তার মায়ের বুকের দুধ, এবং ৬ মাসের উপরের বাচ্চারা মায়ের বুকের দুধ খেলেও সেটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাচ্চাদের প্রধান খাদ্য থাকে না। বিষয়টি আরও বোধগম্য হবে লেখার তিন নং শর্তটি পড়ার পর।

২. অ্যামেনোরিয়ার যথার্থতা

খেয়াল রাখতে হবে আপনার মাসিক রক্তচাপ এখনো ফিরে আসেনি। এরমানে হচ্ছে- একজন মহিলা ততক্ষণ পর্যন্ত গর্ভধারণ করবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তার অভুলেশন ঘটবে না। আর ততক্ষণ পর্যন্ত তার অভুলেশন ঘটবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তার পিরিয়ড হবেনা। উদাহরণ স্বরুপ- একটা সাত বছরে বাচ্চা মেয়ে, তার অভুলেশন ঘটেনা, কারন তার পিরিয়ডই হয়না। আবার মনোপজের মধ্য দিয়ে যাওয়া ৭০ বছরের একজন মহিলা তারও অভুলেশন ঘটেনা, কারন ঐ বৃদ্ধারও পিরিয়ড হয় না। অর্থ্যাৎ- আপনি যত ছোট বাচ্চাকেই বুকের দুধ খাওয়ান না কেন, আপনাকে খেয়াল রাখতে হবে- আপনার পিরিয়ড বন্ধ আছে কিনা।

৩. স্তন্যদানের মাত্রা

আপনাকে অবশ্যই একচেটিয়া কিংবা আধাচেটিয়াভাবে বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। এখানে একচেটিয়াভাবে বুকের দুধ খাওয়ানো বলতে যা বোঝায়, দিন-রাত আপনার বাচ্চার চাহিদা অনুযায়ী তাকে দুধ পান করানো কিংবা বুকের দুধই বাচ্চার প্রধান খাদ্য। আর আধাচেটিয়া বলতে বাচ্চার খাবারের চার ভাগের তিন ভাগই বুকের দুধকে বোঝায়।

ল্যাকটেশনাল অ্যামেনোরিয়া কতটা কার্যকরী?

এর কার্যকারিতা ব্যবহারকারীর উপর নির্ভর করে। গর্ভধারণের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি হয় যখন একজন মহিলা তার শিশুকে সম্পূর্ণ বা প্রায় সম্পূর্ণরূপে বুকের দুধ খাওয়াতে পারেন না।

গবেষণা দেখায় যে, সাধারণ ব্যবহৃত হিসাবে, প্রসবের পর প্রথম ৬ মাসে ল্যাকটেশনাল অ্যামেনোরিয়া ব্যবহার করে প্রতি ১০০ জন মহিলার ২ জন গর্ভধারণ করে। এর মানে হল, শুধুমাত্র এই পদ্ধতির উপর নির্ভর করে যারা পরিবার পরিকল্পনা করেন তারা ৯৮% গর্ভাবস্থায় সুরক্ষিত।

একইসাথে গবেষণা এটাও দেখায় যে পদ্ধতিটির নিখুঁত ব্যবহারে এটি ৯৯ শতাংশেরও বেশি সুরক্ষা দিতে সক্ষম।

ল্যাকটেশনাল অ্যামেনোরিয়ার স্থায়িত্বকাল

ল্যাকটেশনাল অ্যামেনোরিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে নারীর উর্বরতা ফিরে আসে। একজন মহিলা দিনে কতটা বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন তার উপর নির্ভর করে প্রক্রিয়াটি একসময় আপনা আপনিই বন্ধ হয়ে যায়।

কেউ যদি সন্তান জন্মদানের পরপরই ফিডারের দুধ খাওয়াতে থাকেন তিনি ২১ দিনের মধ্যেই পরবর্তী বাচ্চা ধারনের জন্য উপযুক্ত হয়ে উঠবেন।

প্রকৃতপক্ষে, সন্তান জন্মদানের পরপরই অন্য আরেকটি সন্তান আসুক, এটা কোন বাবা মা’ই চায় না। তাই এই সময় কোন ধরনের ঝুকি নিতে চায় না বাবা-মায়েরা। আপনি যদি ল্যাকটেশনাল অ্যামেনোরিয়া কার্যকরী হওয়ার তিনটি শর্তই একসাথে পূরণ করেন, তাহলে আপনি এই পদ্ধতিটি অবলম্বন করতে পারেন, অন্যথায় যদি আপনার আত্মবিশ্বাসের কমতি থাকে তাহলে ‘মিনিপিলের’ ব্যাপারে মনোনিবেশ করুন।

Scroll to Top